পূর্ববর্তী শ্রেণিগুলোতে তোমরা নাটক সম্পর্কে ধারণা পেয়েছ। কোনো একটি বিষয়কে অবলম্বন করে কাহিনি, চরিত্র ও সংলাপের মাধ্যমে কীভাবে একটি নাটক তৈরি হয়, সে সম্পর্কে জেনেছ। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে এখন তুমি ২৫০-৩০০ শব্দের মধ্যে একটি নাটক লেখো। নাটকটি বাস্তব কোনো ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত হতে পারে, আবার কোনো কাল্পনিক ঘটনার উপর ভিত্তি করেও রচিত হতে পারে। নাটক রচনা হয়ে গেলে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সামনে উপস্থাপন করো।
তোমার লেখা নাটকে নিচের বিষয়গুলো আছে কি না যাচাই করে দেখো-
নাটক সংলাপ-নির্ভর রচনা। নাটকে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে কাহিনি সাজানো হয় এবং সেই কাহিনি ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। নাটকের ঘটনাগুলো এক বা একাধিক দৃশ্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ঘটনা ফুটিয়ে তুলতে চরিত্রের প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় সংলাপের। নাটক মূলত অভিনয়ের জন্য রচনা করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাটক রচিত হয়। বিষয় অনুযায়ী নাটক অনেক রকমের হতে পারে; যেমন সামাজিক নাটক, ঐতিহাসিক নাটক, রাজনৈতিক নাটক ইত্যাদি। আবার নাটকের পরিণতি অনুযায়ী নাটককে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেসব নাটকের শেষ হয় দুঃখের মধ্য দিয়ে, সেগুলোকে বলে ট্র্যাজেডি। আর যেসব নাটকের শেষ হয় আনন্দের মধ্য দিয়ে, সেগুলোকে বলে কমেডি।
যিনি নাটক রচনা করেন তাঁকে নাট্যকার বলে। যাঁরা নাটকে অভিনয় করেন, তাঁদের বলে অভিনেতা। যিনি নাটক পরিচালনা করেন বা নির্দেশনা দেন, তাঁকে বলে পরিচালক বা নির্দেশক। নাটকে মঞ্চ সাজানো, অভিনেতাদের সাজসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ, শব্দ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন লোক দায়িত্ব পালন করেন।
কোনো নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে কয়েকবার অনুশীলনের দরকার হয়। এই অনুশীলনের নাম মহড়া।
ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮) 'প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ' নামে পরিচিত। ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম 'কামাল পাশা', 'আনোয়ার পাশা' 'ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র' ইত্যাদি।
মানসিংহ
দুর্জয়সিংহ
দূত
ঈসা খাঁ
[স্থান: এগারোসিন্ধুর। মহারাজ মানসিংহের শিবির।]
মানসিংহ: শোনা যায়, একদা এক অসুররাজ গোস্পদে ডুবে মরেছিল। একথা বিশ্বাস করো, দুর্জয়সিংহ?
দুর্জয়সিংহ : এ পুরাণের কাহিনিমাত্র। বিশ্বাস করি না।
মানসিংহ: আমিও আগে বিশ্বাস করতাম না, দুর্জয়সিংহ, কিন্তু এখন বিশ্বাস করি।
দুর্জয়সিংহ: সত্যি বিশ্বাস করেন, মহারাজ?
মানসিংহ: চোখের সামনে যা ঘটে গেল, দুর্জয়সিংহ, তাতে বিশ্বাস না করি কেমনে, তাই বলো। নইলে বাংলার এক অজ্ঞাতনামা ক্ষুদ্র পাঠানসর্দার ঈসা খাঁ, তাঁরই তলোয়ারতলে মারা যায় ক্ষত্র-বীর মানসিংহের আপন জামাতা?
দুর্জয়সিংহ: আশ্চর্যই বটে!
মানসিংহ: মানুষ হয়ে জন্মেছিল, একদিন তো সে মরতই না হয় দুদিন আগে মরেছে। কিন্তু রাজপুতনার মরুসিংহ মারা গেল বাংলার বকরির হাতে-এ দুঃখ রাখবার স্থান কোথায়, দুর্জয়সিংহ?
দুর্জয়সিংহ মহারাজ, এ দুঃখ করতে পারেন।
মানসিংহ: জামাতা নিহত হয়েছে, কিন্তু তারও চেয়ে বড়ো দুঃখ যে, এই কাহিনি শুনে রাজপুতনার নারীরা হাসবে, শত্রুরা উপহাস করে রটনা করবে, আমি নিজে ভয় পেয়ে ঈসা খাঁর সামনে আমার জামাতাকে পাঠিয়েছিলাম। অনেকে ভাববে, আমরা কাপুরুষ।
দুর্জয়সিংহ এ বিধাতার বিধান, মহারাজ, সয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
মানসিংহ : না। আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করব আমি ঈসা খাঁকে হত্যা করব। দুর্জয়সিংহ কিন্তু সে কী করে সম্ভব হবে?
মানসিংহ : ঈসা খাঁ আমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল, পাঠিয়েছিলাম আমার জামাতাকে। আমার জামাতাকে হত্যা করে ভেবেছে, সে বুঝি মানসিংহকেই হত্যা করেছে। আমি তাকে জানিয়েছি, ঈসা খাঁর মুণ্ডপাত করার জন্য মানসিংহ এখনও জীবিত রয়েছেন। এবার দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গিয়েছে আমার তরফ থেকেই।
দুর্জয়সিংহ: কোনো উত্তর পেয়েছেন?
মানসিংহ : না, তবে এক্ষুনি পাব। জানি না; সে কাপুরুষ পুনরায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজি হবে কি না।
[দূতের প্রবেশ।]
দূত : (কুর্নিশ করে) মহারাজের জয় হোক!
মানসিংহ : কী সংবাদ, দূত?
দূত : সংবাদ শুভ। মহারাজকে হত্যা করেছে ভেবে তারা উৎসব করছিল; এমন সময়ে আপনার আহ্বান নিয়ে আমি হাজির! তবে ঈসা খাঁ এ আহ্বান গ্রহণ করেছেন।
মানসিংহ : গ্রহণ করেছেন? অনেকক্ষণ পরে নিশ্চয়ই?
দূত : না মহারাজ! তক্ষুনি গ্রহণ করেছেন।
মানসিংহ: তক্ষুনি? আচ্ছা, তা বেশ। কোনো জবাব এনেছ?
দূত : এনেছি, মহারাজ! তবে দেখাতে সাহস হয় না।
মানসিংহ: তোমাকে অভয় দিচ্ছি, দূত।
দুত : মহারাজ, ঈশা খাঁ লোকটা, নিতান্ত... নিতান্ত... এই নিতান্ত....
মানসিংহ: নিতান্ত কী? দূত : আজ্ঞে, নিতান্ত গোঁয়ার। কারণ মহারাজের আহ্বানপত্র পেয়েই অমনি তলোয়ার খুললেন, তারপর নিজের হাত কেটে তারই রক্তে তলোয়ারের ডগা দিয়ে উত্তর লিখলেন- 'বহুত আচ্ছা'।
[স্থান: লড়াইয়ের ময়দান। একদিকে পাঠান শিবির, অন্যদিকে মোগল শিবির। অদূরে এগারোসিন্ধুর কেল্লা। ময়দানের মাঝখানে ঈসা খাঁ ও মানসিংহ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে।]
ঈসা খাঁ : নমস্কার, মহারাজ।
মানসিংহ: আদাব, খাঁ সাহেব।
ঈসা খাঁ : এত তকলিফ করে এখানে না এসে মহারাজ যদি আদেশ করতেন, তবে দিল্লিতে গিয়েই মহারাজের সঙ্গে আমি একহাত লড়ে আসতাম।
মানসিংহ : বাংলার ঝোপে-জঙ্গলে আপনারা কেমন আছেন, একটু দেখতে শখ হলো, খাঁ সাহেব।
ঈসা খাঁ : রাজপুতনার মরু-পর্বতের কোন অন্ধকার গুহায় মহারাজ কীরূপে থাকেন, তা দেখবার কৌতূহলও তো এ বান্দার হতে পারত।
মানসিংহ: পাঠানেরা দেখছি ইদানীং কথা বলতে শিখেছে।
ঈসা খাঁ : এ আপনাদের মতো কথাসর্বস্বদের সঙ্গে থাকার ফল। আগে পাঠানেরা কথা বলত না; কথা বলত কেবল তাদের তির আর তলোয়ার।
মানসিংহ: ইদানীং বুঝি তাহলে পাঠানদের তির-তলোয়ার ভোঁতা হয়ে পড়েছে।
ঈসা খাঁ : শাহি ফৌজের ওপর ক্রমাগত ব্যবহারে একটু ভোঁতা হয়েছে বৈকি।
মানসিংহ : তাহলে এখন তলোয়ার ছেড়ে কাবুলি মেওয়ার কারবার শুরু করলে হয় না, খাঁ সাহেব?
ঈসা খাঁ : কিন্তু কাবুলি মেওয়া এখানে খাবে কে? মহারাজের তো বাজরার খিচুড়ি আর ঘাসের রুটি খেয়ে খেয়ে পেট এমনি হয়েছে যে, কাবুলি আঙুরের গন্ধেই বমি আসে।
মানসিংহ : কিন্তু খাঁ সাহেব কি কেবল কথার যুদ্ধের জন্যই তৈরি হয়ে এসেছেন, না আরও কোনো মতলব আছে?
ঈসা খাঁ : সে সম্পূর্ণ মহারাজের অভিরুচি। ঈসা খাঁ যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থানে যে কোনো অস্ত্রে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত।
মানসিংহ: মনে হচ্ছে, শাহবাজ খাঁকে পরাজিত করে ঈসা খাঁর অহংকার বেড়েছে। কিন্তু ঈসা খাঁ কেবল ঘুঘু দেখেছেন, ফাঁদ দেখেননি।
ঈসা খাঁ : কিন্তু ফাঁদের সঙ্গে যে এ বান্দার কিঞ্চিৎ পরিচয় ঘটেছে এই মাত্র সেদিন-সে তো মহারাজের অজানা থাকবার কথা নয়।
মানসিংহ : সে কথা জানি, কাপুরুষ। আমার জামাতা-এক অনভিজ্ঞ তরুণ যুবক-বাগে পেয়ে তাকে তুমি হত্যা করেছ।
ঈসা খাঁ : খবরদার মানসিংহ। ঈসা খাঁকে 'কাপুরুষ' বলে কেউ কোনোদিন রেহাই পায়নি। আর ঈসা খাঁ নিজে পর্দার আড়ালে থেকে জামাতাকে কখনও লড়াইয়ে পাঠায়নি। কিন্তু আজ তোমাকে ক্ষমা করছি সেই মহান যুবকের নামে, যিনি বীরের মতো যুদ্ধ করে সমর শয্যা গ্রহণ করেছেন।
মানসিংহ : ভূতের মুখে রাম নাম! কিন্তু আত্মরক্ষা করো, ঈসা খাঁ।
ঈসা খাঁ : তুমিও আত্মরক্ষা করো মানসিংহ।
[যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ করতে করতে ঈসা খাঁর তলোয়ারের আঘাতে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙে পড়ে গেল। নিরস্ত্র মানসিংহ ভীতভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।]
ঈসা খাঁ : এখন মহারাজকে রক্ষা করবে কে?
মানসিংহ: কেউ না; তুমি আমাকে হত্যা করো, ঈসা খাঁ।
ঈসা খাঁ : না, মহারাজ, সে হয় না। নিরস্ত্রের ওপর ঈসা খাঁ ওয়ার করে না।
মানসিংহ: তবে আমাকে বন্দি করো, আমি তোমার অনুগ্রহ চাই না।
ঈসা খাঁ : তাও হয় না মহারাজ। আপনার মতো সাহসী যোদ্ধাকে বাগে পেয়ে আমি বন্দি করব না। এই নিন আমার তলোয়ার-যুদ্ধ করুন।
[নিজ তলোয়ার মানসিংহের হাতে তুলে দিয়ে বাম কটি থেকে অন্য তলোয়ার খুলে দাঁড়ালেন।]
মানসিংহ: (একটু ভেবে তলোয়ার ছুড়ে ফেলে দিলেন) আমি লড়ব না।
ঈসা খাঁ : কেন, মহারাজ?
মানসিংহ: আপনার সঙ্গে আমার যুদ্ধ নেই।
ঈসা খাঁ : বটে।
মানসিংহ : ঈসা খাঁ, চমৎকার। দূর হতে তোমার কত নিন্দাই শুনেছি, ভাই কাছে এসেও এতদিন তোমাকে চিনতে পারিনি। আজ তোমার সঙ্গে সত্যিকার পরিচয় হলো, এই-ই আমার পরম লাভ! তোমাকে চিনবার আগে মরলে মানসিংহের জীবনে একটা মস্ত ফাঁক থেকে যেত।
ঈসা খাঁ : মহারাজ ভাই তোমার হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আমিও ধন্য।
মানসিংহ : তবে, এসো ভাই! (আলিঙ্গন করে) আমাদের এই আলিঙ্গনের ভিতর দিয়ে মোগল-পাঠানের বন্ধুত্ব হোক, ভারতের হিন্দু-মুসলমানের মিলন হোক আর কখনো আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির পবিত্র বক্ষ কলঙ্কিত করব না।
অসুররাজ: অসুরদের রাজা।
ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি: বিপদের ভয় দেখানো।
ডগা: অগ্রভাগ।
আহ্বানপত্র: আমন্ত্রণপত্র।
ঈসা খাঁ: ষোলো শতকের বাংলা অঞ্চলের একজন রাজা।
তকলিফ: কষ্ট।
বকরি: ছাগল।
এগারোসিন্ধুর: কিশোরগঞ্জের একটি জায়গার নাম।
বহুত আচ্ছা: খুব ভালো।
ওয়ার: আঘাত।
বাজরা: শস্য বিশেষ।
কথাসর্বস্ব: কাজের থেকে যার কথার জোর বেশি।
কুর্নিশ: মাথা নত করা।
মেওয়া: ফল।
মানসিংহ: মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি।
ক্ষত্র-বীর: ক্ষত্রিয় বীর।
রাজপুতনা: রাজস্থান; ভারতের একটি প্রদেশ।
গোষ্পদ: গোরুর খুরের চাপে তৈরি গর্ত।
আরও দেখুন...